শিক্ষা জাতীয়করণ ও কাঠমিস্ত্রীর ইনসাফ
মো. মেজবাহুল ইসলাম প্রিন্স
বিশ্ব শিক্ষক দিবস প্রতিটি বছরই আসে এবং ফিরে যায়। এর আগমন বোঝা যায় নির্দিষ্ট কিছু সেমিনার এবং শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে। এর ফলে সবার কিছুটা নির্মল আনন্দ, দায়িত্ব পালন এবং সান্ত্বনা পাওয়া যায় বটে, কিন্তু বিষয়টির বিশালতা কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এই গতানুগতিক উদযাপন এবং বক্তব্য শিক্ষা বিস্তারের ব্যাপকতা প্রকাশে তেমন ভূমিকা রাখতে পারে না।
একটা জাতির উন্নয়নের প্রধান মাপকাঠি হলো তার শিক্ষার হার। কিন্তু আমাদের দেশ এখনো, এই ২০২২ খ্রিষ্টাব্দেও শিক্ষা সূচকে পিছিয়ে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ শিক্ষার সূচকে একটি মাত্র ক্ষেত্র মাধ্যমিক শিক্ষা ছাড়া সকল ক্ষেত্রেই পিছিয়ে রয়েছে। ইউএনডিপির ২০২১ এর রিপোর্ট অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষাসূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫০টি দেশের মধ্যে ১২০ তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ৪র্থ। অর্থাৎ আমাদের দেশের পেছনে রয়েছে পাকিস্তান, নেপাল ও আফগানিস্তান। যদিও ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে আমাদের বৈশ্বিক অবস্থান ছিল ১১২তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ছিল সর্বনিম্ন। পরিসংখ্যানে বোঝা যায়, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় দেশগুলোর মধ্যে শিক্ষাসূচকে এগিয়েছি, কিন্তু বৈশ্বিক সূচকে পিছিয়েছি। এর কারণ করোনাসহ আরো বহুবিধ হতে পারে।
তবে একটি সূচকে আমরা দক্ষিণ এশিয়ায় সবার শীর্ষে অবস্থান করছি। তা হলো মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার সমতুল্য দক্ষতা অর্থাৎ প্রথাগত পড়তে জানা এবং গণিত পারার দক্ষতা। আর এই বিষয়গুলো মাধ্যমিক পর্যায়েই বেশি শেখানো হয়। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে (যা বাংলাদেশে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিস্তৃত এমন সকল প্রতিষ্ঠানে) শিক্ষার্থীরা পঠন এবং গণিত বিষয়ের দক্ষতায় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। ২০১৯ এ বিশ্বব্যাংকের জরিপে দেখা যায়, প্রাথমিকের ৬৫% শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে না, ইংরেজি ও গণিতে দুর্বল। সেই দুর্বল শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিকে এসে কী এক জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় দক্ষিণ এশিয়ায় শিক্ষা সূচকে প্রথম হয়? সেই জাদুর কাঠিটি হলো বেসরকারি শিক্ষকদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা এবং আন্তরিকতা।
মাধ্যমিক পর্যায়ে ২৯,৫৯১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে স্কুল ও কলেজ মিলিয়ে প্রায় ৬৬২টি সরকারি এবং বাকি প্রায় ২৯,০০০ প্রতিষ্ঠান বেসরকারি। আর প্রায় এক কোটি চল্লিশ লাখ শিক্ষার্থীর ৯৫% বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে। তাহলে শিক্ষা সূচকে মাধ্যমিকের এই যে শক্তিশালী অবস্থান তার ৯৫% বেসরকারি শিক্ষকদের অবদান।
শিক্ষকগণকে অভিনেতা হতে হয়। শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের তাৎক্ষণিক জবাব দিতে হলে তাকেও কিছুটা অভিনয় করতে হয়। তবে বেসরকারি শিক্ষকদের অভিনয়টা একটু বেশি করতে হয়। কারণ তার পকেটে টাকা না থাকতে পারে, পেটে খাবার না থাকতে পারে, শরীরে পুষ্টির অভাব থাকতে পারে, বৃদ্ধ মা বাবার জন্য ওষুধ কেনা অসম্ভব হতে পারে, সন্তানের জন্য ঈদে জামা কাপড় নাও কিনতে পারে, তবু্ও তাকে পরিপাটি একটি শার্ট পরিধান করেই হাসিমুখে শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়াতে হয়, তাদের নতুন এক ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে, তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতে গড়ে তুলতে, জাতিকে অনন্য এক উচ্চতায় আরোহন করাতে। আর সেই প্রদীপের উজ্জ্বল আলোর নিচে, এক গভীরতম অন্ধকার ভবিষ্যৎ নিয়ে ধীরে ধীরে অবসরের দিকে এগিয়ে যায় একজন বেসরকারি শিক্ষক যার কোনো পেনশন নেই, অবসর ভাতা সীমিত এবং জীবদ্দশায় তা অনেকাংশেই অনিশ্চিত।
কী লজ্জা, তাই না? এ লজ্জা আামাদের। আমাদের সকলের।
সরকার হলো সর্বোচ্চ ইনসাফের প্রতিষ্ঠান। যে শিক্ষকগণ দেশের মাধ্যমিকের ৯৫% শিক্ষাকে আগলে রাখছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় দক্ষতায় প্রথম বানিয়েছেন তাদের প্রতি এ কেমন ইনসাফ, বুঝতে একেবারেই অক্ষম।
একজন কাঠমিস্ত্রী ও তার কাঠের প্রতি ইনসাফ করেন, তার হাত দিয়ে স্পর্শ করে বুঝতে চেষ্টা করেন, উঁচুনিচু অংশগুলোকে সমান করেন। এর কারণটাও তিনি জানেন, যত বড়ো কাঠামো তৈরি হোক না কেন, সামান্য অসমতা তাকে ভেঙে দিতে পারে। একজন মেষপালক কিংবা রাখাল, তাদের দিকে খেয়াল করুন। কী অসামান্য দক্ষতায় সবার প্রতি খেয়াল রাখেন! সমাজ যখন এগিয়ে যায় অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিক সূচকে তখন দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের খুঁজতে হয়্ কোথাও কোনো অনগ্রসর অংশ বা পকেট রয়ে গেল কিনা এবং সেভাবেই ব্যবস্থা নিতে হয়।
আমরা কি তাহলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষার প্রতি ভাবনাগুলো বুঝতে পারছি না। প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করে তিনি দেশকে কতোটা এগিয়েছেন, তা কি বুঝতে পারছি না? প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ না হলে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসার কী অবস্থা হতো, তা কি ভাবা যায়? এক পোলিও রোগেই কোটি মানুষের মৃত্যু অথবা অঙ্গহানি হতো। প্রাথমিকের এই শিক্ষকগণ কি পরিশ্রমটাই না করেছেন টিকা হতে শুরু করে প্রতিটি জাতীয় প্রয়োজনে এবং এখনো করে যাচ্ছেন। তাই বাজেট করার সময় আমাদের মনে রাখা উচিত বঙ্গবন্ধুর উক্তিগুলো, ‘শিক্ষায় জন্য খরচ কোনো ব্যয় নয় বরং তা উত্তম বিনিয়োগ।”
যত বড়োই হোন না কেন, বঙ্গবন্ধুকে ছাপিয়ে যাওয়ার মতো কেউ নন। সাতশো কোটি টাকার বাজেটে ৩৮ হাজার স্কুল জাতীয়করণ। বাজেটে প্রবৃদ্ধির ৬% শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যয় করার ভাবনা। ভাবা যায়? আর আজকের বাজেট ছয় লাখ কোটি টাকার ওপরে।
প্রাথমিক শিক্ষার প্রায় ৭০% সরকারি, উচ্চ শিক্ষার ও প্রায় ৭৫% শিক্ষার্থী সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করার সুযোগ পায়। সেখানে কি এক অজানা কারণে মাধ্যমিক শিক্ষার মাত্র ৩% (৬৬২টি) সরকারি। অথচ যে বৃটিশরা মাধ্যমিক শিক্ষা সৃষ্টি করেছিলেন বেসরকারি সহায়তায়, তাদের দেশের ৭০% সরকারি প্রতিষ্ঠান। কি জানি, হয়তোবা জন্মই এর আজন্ম পাপ।
এই বিশ্ব শিক্ষক দিবসে প্রতি বছর বেসরকারি শিক্ষকগণ ঢাকায় আসেন তাদের কৃতিত্বকে উদযাপন করতে নয় বরং তাদের বঞ্চনার ইতিহাসগুলো তুলে ধরতে গোলটেবিল বৈঠকে, রাজপথের র্যালিতে, প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনে। কখনো সেখানে মন্ত্রী মহোদয়রা থাকেন, থাকেন শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব, থাকে তাদের অফুরন্ত আফসোস কিংবা সান্ত্বনার নির্ভেজাল বাণী আর প্রাণবন্ত আলোচনা। তবে, কোনো কিছুই কোনো নতুন বার্তা নিয়ে আসে না। সবই যেন রঙহীন ফানুস। তাদের ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা, যা ১৯ বছরে পদার্পণ করেছে, এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া যা কোনো এক আদিম গুহাবাসের কথা মনে করিয়ে দেয়, কিংবা ৫০০ টাকার অপ্রতুল চিকিৎসার ভাতা কোনো এক নিভৃত জনপদের চিকিৎসকের এক নিমিষ দর্শনের ফি মাত্র।
বঙ্গবন্ধুর ভাবনাকে কাটছাট করে, জিডিপির ২ শতাং শিক্ষা বাজেট রেখে, অবকাঠামো উন্নয়নে সেরা বাংলাদেশের লাল-সাদা দালানে পাঠদানে ব্যস্ত বেসরকারি মাধ্যমিকের রুগ্ন শিক্ষককে কম বেতন দিয়ে, কম ভাড়া দিয়ে, কম বোনাস দিয়ে, যতোই বঞ্চিত করুন না কেন, প্রশস্ত বারান্দা হতে ঠিকই শুনতে পাবেন হাড় জিরজিরে শিক্ষকদের পাঠদানের উচ্চকিত আওয়াজ। আমরা অন্তত জাতিকে ঠকাবো না। আগামীর লক্ষ্যগুলো পুরণ করবোই, ইনশাআল্লাহ।
লেখক :
মো. মেজবাহুল ইসলাম প্রিন্স,
মহাসচিব,
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
মন্তব্য করুন