ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষা ইনস্টিটিউটের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত, থাকছে একগুচ্ছ সুপারিশ
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলো থেকে তথ্য সংগ্রহের পর প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনিস্টিটিউটের গবেষকদল। রোববার (২২ জানুয়ারি) মাদ্রাসা বোর্ডে সেই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন গবেষকদলের এক সদস্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা ইনস্টিটিউটের ওই গবেষক জানান, মোট চারটি মূল বিষয়কে আমলে নিয়ে গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। গবেষণার ক্ষেত্রে আমরা মাদ্রাসাগুলোর বর্তমান অবকাঠামোগত অবস্থা, শিক্ষার মান, আর্থিক অবস্থা ও সমপর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে মাদ্রাসাগুলোর সার্বিক অবস্থা সরেজমিনে জেনেছি।
তিনি বলেন, এই গবেষণার আলোকে শিক্ষা ইনস্টিউট একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করেছে। রোববার মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের কাছে সুপারিশসহ প্রতিবেদনটি দাখিল করা হতে পারে।
সংশ্লিষ্টসূত্রে জানা গেছে, গত ৩ জানুয়ারি ইবতেদায়ি মাদ্রা শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিল শিক্ষা ইনস্টিটিউটের গবেষকদল। সেখানে একটি খসড়া সুপারিশমালা উপস্থান করা হয়।
খসড়া সুপারিশপত্রে দেশের স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলোতে অতিসত্তর অনুদান চালুকরণ ও শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধিতে নীতিমালা প্রণয়ন ও উদ্যোগ গ্রহণসহ ১১ টি সুপারিশ উল্লেখ ছিল।
খসড়া সুপারিশপত্রে ইবতেদায়ি মাদ্রাসার প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে শুমারী সম্পাদন, মাদ্রাসাগুলোতে অতিসত্তর অনুদান চালুকরণ ও শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধিতে নীতিমালা প্রণয়ন ও উদ্যোগ গ্রহণ, মাদ্রাসাগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে ‘ইনডিপেন্ডেন্ট ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ডেভলপমেন্ট প্রোগ্রাম’ হাতে নেওয়া, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসা নীতিমালা-২০১৮ বাস্তবায়ন, মাদ্রাসাগুলোকে পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের উদ্যোগ গ্রহণ, শিক্ষকদের ন্যুনতম বেতনস্কেল প্রদান, অবসরকালীন সুবিধাদি নিশ্চিতকরণে ব্যবস্থা গ্রহণ, উপজেলা পর্যায়ে পর্যন্ত মাদ্রাসাগুলোর জন্য প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তন, শিক্ষার্থীদের জন্য অবৈতনিক শিক্ষা ও উপবৃত্তি প্রবর্তন ও মানসম্মত অবকাঠামো নিশ্চিতকল্পে মাদ্রাসাগুলোর জন্য থোক বরাদ্দের উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে।
তবে চূড়ান্ত সুপারিশপত্রে কিছু বিষয় সংযোজন ও বিয়োজন হতে পারে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা শীঘ্রই প্রতিবেদন দাখিল করব। তখন মাদ্রাসা বোর্ড সহ সংশ্লিষ্ট করতপক্ষ বিষয়গুলো নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করবেন।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই খসড়া প্রতিবেদনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন ইবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকরা। ইবতেদায়ি মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা যেভাবে চেয়েছিলাম খসড়া সুপারিশপত্র সেভাবে প্রস্তুত হয়নি। তারপরও আমরা সন্তুষ্ট। আশা করি, সমীক্ষা কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতে শিক্ষকদের দাবিগুলো বিবেচনা করবেন। আর সরকার অতি দ্রুত যেন এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করে।
জানা যায়, প্রায় চার দশক ধরে পাঠদান করেও বেতন বঞ্চিত রয়েছেন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদ্রাসার ২০ হাজার শিক্ষক। ১৯৮৪ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে অনুমোদন পেলেও এখন পর্যন্ত এমপিওভুক্ত হয়নি মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের এ প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় ক্রমেই কমেছে ইবতেদায়ী মাদ্রাসার সংখ্যা। অনেক শিক্ষক দীর্ঘকাল চাকরি করে বিনা বেতনে গিয়েছেন অবসরে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২১ সালের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে চলমান তিন হাজার ৮৩৯টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার সাড়ে চার লাখ শিক্ষার্থীর পাঠদানে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ২০ হাজার শিক্ষক। তবে, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, বর্তমানে দেশে ৭ হাজার ৪৫৩ টি এবতেদায়ী মাদ্রাসা চলমান রয়েছে। সে হিসাবে এসব মাদ্রাসায় কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার।
জানা গেছে, শিক্ষকরা বোর্ডের অনুমতি পেয়ে কয়েক যুগ ধরে পাঠদান করে আসছেন। কিন্তু বেতন-ভাতার মুখ দেখা হয়নি তাদের। প্রাপ্য সম্মান না পেয়েই অনেক শিক্ষক অবসরে গেছেন। শিক্ষকদের অবমূল্যায়নের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও বঞ্চিত করার অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।
শিক্ষকরা জানান, বেতনের দাবিতে কয়েকদফায় আন্দোলন করেছে স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষকরা। আন্দোলনে বারবার প্রতিশ্রুতি মিললেও বেতন মেলেনি এই শিক্ষকদের। সবশেষ বেতন বৈষম্য নিরসনসহ স্বতন্ত্র মাদ্রাসা সরকারিকরণের দাবিতে ২০১৮ সালে ১ জানুয়ারি থেকে ৮ জানুয়ারি পর্যন্ত জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আন্দোলন করেন কয়েক হাজার শিক্ষক। সরকার তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে আন্দোলন স্থগিত করে শিক্ষকরা বাড়ি ফিরে যান। এরপর স্বতন্ত্র এবতেদায়ী মাদ্রাসার জন্য ‘এমপিও ও জনবল কাঠামো নীতিমালা-২০১৮’ জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু নীতিমালাটি আজও কার্যকর হয়নি।
‘স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি: একটি সমীক্ষা’ শীর্ষক গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্বববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে দায়িত্ব দিয়েছে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। গত ৮ ডিসেম্বর শিক্ষাবোর্ডের একটি প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, গবেষণার জন্য ৩২টি উপজেলার ১২৮টি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিকট থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হবে।
সে অনুযায়ী ঢাকা বিশ্বববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট সমীক্ষার কাজ সম্পন্ন করে গত ৩ জানুয়ারি সমীক্ষা প্রতিবেদন উপস্থাপন ও খসড়া সুপারিশমালা প্রণয়ন করে।
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসার শিক্ষক ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান কাজী মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘আমরা আশাবাদী আমাদের স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদ্রাসাগুলো জাতীয়করণ হবে। আমরা গত অক্টোবর মাসে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনাকালে মাদ্রাসাগুলোকে জাতীয়করণের দাবি জানিয়েছি।’
মন্তব্য করুন